দুদিন পর উদযাপিত হবে ধর্মীয় বড় উৎসব ঈদুল ফিতর। সারা দেশে এ উৎসব উদযাপন করতে প্রস্তুত সবাই। বড়-ছোট সবাই কিনছে নতুন পোশাক। শিশুদের হাত রাঙবে মেহেদি রঙে। ঈদের দিন সেমাই-ফিরনি বা মিষ্টান্ন খাওয়া। নামাজ পড়ে কোলাকুলি করা। একের অন্যের বাড়ি যাওয়াই এ উৎসবের মূল চিত্র। কিন্তু একেবারে ভিন্ন চিত্র কিশোরগঞ্জের হাওরপাড়ে। সেখানে ঈদ উদযাপন প্রস্তুতির নেই ছিটেফোঁটা। কারণ স্বপ্নের বোরো ফসল হারিয়ে দিশেহারা কৃষক পরিবার। ঈদের আনন্দের চেয়ে চোখের জলই এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। ফলে পরিবারের শিশুদের মনেও নেই কোনো আনন্দ।
দেশের বোরো ফসলের ভাণ্ডার খ্যাত জেলা কিশোরগঞ্জ। এ জনপদের মানুষের জীবিকার প্রধান মাধ্যম বোরো ফসল। এ ফসলকে ঘিরেই এ অঞ্চলের কৃষিজীবীদের স্বপ্ন তৈরি হয়। সারা বছরের খরচ জোগান এই ফসল থেকে। এ ছাড়া বিভিন্ন উৎসব-পার্বণও আয়োজিত হয় এই ফসলকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এবার পাহাড়ি ঢলে ফসল ডুবে এ অঞ্চলে দেখা দিয়েছে মহাসংকট।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে ৭০৫ হেক্টর উঠতি বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ইটনা উপজেলার হালালের হাওরপাড়ের চাষিরা।
জানা গেছে, ইটনা উপজেলার হালালের হাওরের বোরোচাষিদের মধ্যে অধিকাংশ চাষি নিজের জমি কিংবা অন্যের জমি পত্তন নিয়ে মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে শ্রমে-ঘামে বুনেছিলেন এ স্বপ্নের সোনালি ফসল। কিন্তু হঠাৎ উজান থেকে আসা ঢলে তলিয়ে যায় সে স্বপ্ন। নিরুপায় হয়ে কেউ কেউ আধাপাকা ধান কেটে ঘরে তোলেন। কিন্তু তা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। চিটা হয়ে গেছে অর্ধেকেরও বেশি ফসল।
এদিকে ধান পুষ্ট না হওয়ায় বেপারিরাও সেই ধান কিনতে চাইছেন না। সেই ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। যে টাকা খরচ করে ধান কেটে বাড়িতে তুলেছেন, সেই টাকাও উঠছে না এখন। তাই এবার আর ঈদ করা হবে না তাদের। ঈদ উৎসবের আগে এমন ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন বোরো চাষিদের চোখের জল আর বানের জল যেন এক হয়ে গেছে। কৃষকদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে হালালের হাওরপাড়ের বাতাস।
সরেজমিনে দুর্ভোগ দেখতে গেলে হালালের হাওরের বোরো চাষি ছালেক মিয়া বলেন, আমি এই বছর পাঁচ একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলাম। আমার সব ধানই তলিয়ে গেছে। এই জমিগুলো চাষ করতে আমার দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। পানির নিচ থেকে যা কেটে এনেছি, তাও চারা গজিয়ে গেছে। আমার ঘরে একমুটও ধান নেই আমার সব শেষ হয়ে হেছে। আমাদের ফসল রক্ষায় হালালারে হাওরে বাঁধ চাই। তা নাহলে প্রতিবারই আমাদের ফসল হারাতে হবে।
মহিউদ্দিন নামে এক কৃষক বলেন, আমি হালালের হাওরে ১০ একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলাম। আমার প্রায় তিন লাখ টাকা খচর হয়েছে। পানিতে ধান তলিয়ে যাচ্ছে দেখে যে ধানগুলো কেটে এনেছি, তা পুষ্ট হয়নি। এই ধানগুলো এখন বেপারিও কিনতে চাইছে না। যে টাকা খরচ করে ধান কেটে এনেছি, এখন সেই টাকাও উঠবে না। আমাদের আবার ঈদ আছে নাকি?
গৃহবধূ ফারজান আক্তার বলেন, আমাদের চার একর জমির ধান সব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। ঈদের জামাকাপড় কিনতে ছেলে-মেয়ে কান্না করছে। খেতেই পারি না, সন্তানকে ঈদের পোশাক কিনে দেব কীভাবে?
এবার ঈদের নতুন জামা কিনেছ কি না, জানতে চাইলে ৯ বছর বয়সী ইউশা বলে, পানিতে ধান তলিয়ে যাওয়ায় মা-বাবার মন ভালো নেই। তাই নতুন জামা কিনে দেয়নি। নতুন জামাও নাই, ঈদের কোনো আনন্দও নাই।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে ৭০৫ হেক্টর উঠতি বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করছি।
তিনি আরও বলেন, যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রণোদনা বা পুনর্বাসন কর্মসূচি দেওয়া হয়, তাহলে এই তালিকা থেকে কমিটির মাধ্যমে মনোনীত কৃষকদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা করব। আমরা এ রকম প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।