বাংলাপেইজ ডেস্ক:
প্রায় ২ কোটির অধিক জনসংখ্যার শহর ঢাকা।বিপুল এই জনসংখ্যার জন্য বাড়ছে পানির চাহিদা। পানির চাহিদা মেটাতে দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা। পানি সরবরাহকারী সরকারি সংস্থা ওয়াসার আস্থাও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর।সংস্থাটি প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করছে তার ৬৬ শতাংশই ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশন এলাকায় গভীর নলকূপ বসানোর নিয়ম না থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা বাড়ছে। এতে চাপ পড়ছে ভূগর্ভস্থ পানি ওপর।ফলে ঢাকায় পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে সুপেয় পানির উৎসএতে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা করছেন পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা। পরিবেশবিদরা বলছেন, ভূর্গভস্থ থেকে পানি উত্তোলন করতে থাকলে ঢাকায় ভূমিকম্পসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে। সুপেয় পানির সংকট বাড়বে। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের শীর্ষে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম রয়েছে। তালিকায় সপ্তম স্থানে বাংলাদেশ। যদিও ঢাকা ওয়াসার দাবি, ভূর্গভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহের পরিমাণ বাড়ানো হবে। ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা তিন লাখের বেশি। প্রতিদিন পানির চাহিদা মেটাতে ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে সংস্থাটি। এর মধ্যে ৩৪ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাকি ৬৬ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে আসে। তবে কয়েক শতাংশ সিস্টেম লসের কারণে দৈনিক প্রায় ৫০ কোটি লিটার পানি গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছায় না। এতে বিভিন্ন এলাকায় পানির ঘাটতি থাকছেই। এর আগে বর্তমান সরকার প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি গ্রহণ করে ঢাকা ওয়াসা। কর্মসূচি অনুযায়ী, মাটির নিচের পানি ব্যবহার কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়। গভীর নলকূপ কমিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয় সংস্থাটি। সে অনুযায়ী টেকসই, গণমুখী ও পরিবেশবান্ধব পানি সরবরাহ করার কথা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত উল্টো ঢাকায় গভীর নলকূপ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এতে
ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা রয়েই যাচ্ছে। ওয়াসার সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপ ছিল ৫১৯টি। বর্তমানে গভীর নলকূপ রয়েছে ৯০৬টি। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় ৮১টি, পুরান ঢাকায় ৭০টি, ধানমন্ডি এলাকায় ১৩৭টি, মিরপুর-১ এ ১১৫টি, গুলশান-মহাখালীতে ৭৭টি, ফকিরাপুলে ১১৮টি, শনির আখড়া, মাতুয়াইলে ৫৬টি, বাড্ডায় ৭৩টি, উত্তরায় ৭৫টি, মিরপুর ১০ এ ১০৪টি। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় আরও অন্তত ২০টি নলকূপ স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। ২০১৪ সালে সাভারের ভাকুর্তায় ৫৭২ কোটি টাকা খরচ করে একসঙ্গে ৪৬টি গভীর নলকূপ বসায় ঢাকা ওয়াসা। সেখান থেকে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে মিরপুর অঞ্চলে। ভাকুর্তার এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের কথা। তবে বাস্তবে আরো কম পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে মিরপুর এলাকায় পানি সংকট লেগেই আছে। মহাখালী, বনানী, গুলশান এলাকার বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে আটটি নতুন নলকূপ স্থাপনে অনুমোদন দেয় ওয়াসা। এর মধ্যে মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ) সংলগ্ন মন্দির গলিতে একটি নলকূপ স্থাপন করা হয়। এই কূপ থেকে আড়াই হাজার গ্রাহককে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে কি পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তার পরিসংখ্যান নেই কর্মকর্তাদের কাছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯৯০ সালে ১৩০টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হতো। তখন সাড়ে ২২ মিটার নিচ থেকে পানি পাওয়া যেত। ২০০৫ সালে নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪২৩, পানির স্তর নামে ৫৪ মিটারে। ২০২২ সালে এসে নলকূপের সংখ্যা ৯শ ছাড়িয়ে গেছে। আর পানির স্তর নেমেছে অন্তত ৮০ মিটারে। সংস্থাটি বলছে এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরে পানির স্তর আরো নিচে নেমে যাবে। যা নগরবাসীর জন্য বিপদ বয়ে আনবে। সম্প্রতি এক সংলাপে অংশ নিয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসীম এ খান বলেন, ২০২৩ সাল নাগাদ ঢাকা শহরে সরবরাহ করা পানির ৭০ শতাংশ আসবে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ। এভাবেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ বা নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো হবে। এটি বাস্তবায়নে এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান মানবজমিনকে বলেন, প্রতিবছর গড়ে ২ থেকে ৩ মিটার করে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ওপর ঝুকি বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে ওয়াসাকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। যেহেতু প্রতিবছরই পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানির উপর গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। এখনো মাটির নিচ থেকে সুপেয় পানি পাওয়া যায়। তবে সুপেয় পানি বিভিন্ন লাইনে ঢুকে গুণগতমান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওয়াসার পানির গুণগতমান পরীক্ষার করার জন্য সংস্থাটির ২টি শক্তিশালী ইউনিট রয়েছে। তবে তারা সেভাবে কাজ করছে না। পানির মান পরীক্ষার ইউনিট নিয়মিত কাজ করলে রাজধানী বিভিন্ন এলাকার মানুষ সুপেয় পানি খাওয়ার সুযোগ পেত। সব মিলেয়ে ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমাতে হবে। অন্যথায় বিপদ বাড়বে। সংশ্লিষ্টদেরকে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।