ব্যারিস্টার নাজির আহমদ:
সুস্থ, অবাধ ও নলেজভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ ও রক্ষায় সাংবাদিকরা এক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা এক প্রধান মৌলিক উপাদান।
যে সব স্টেইকহোল্ডাররা সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেন তাদের মধ্যে অগ্রগামী হচ্ছেন সাংবাদিকরা। অনুসন্ধানী সংবাদ ও রিপোর্টের মাধ্যমে সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাজের অসংগতিগুলো জাতির সামনে তুলে ধরেন।
বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকরা দেশ ও জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়ে জাতির কল্যাণ সাধন করতে পারেন বলেই সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। সাংবাদিকরা জাতির দর্পনও কেননা তাদের মাধ্যমেই সাধারণ জনগণ ধারাবাহিকভাবে জাতিকে দেখে, চিনে ও জানে। একটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি বলা যেতে পারে সাংবাদিকতাকে। এজন্য সংবাদপত্রকে একটা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা দিয়েছে। বিশেষ করে ৩৯(২)(খ) অনুচ্ছেদে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সংবিধানগুলো ঘাটলে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক্-স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদানের সুস্পষ্ট প্রভিশন বা বিধান পাওয়া যায়। Universal Declaration of Human Rights (UDHR) এবং International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) – এ দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য ও signatory বাংলাদেশ। UDHR-এর Article 19 এবং ICCPR-এর Article 19(2) প্রায় অভিন্ন ভাষায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক্-স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
সুতরাং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করণে, সংবিধান সমুন্নত রাখতে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দ্বায়বদ্ধতা রক্ষার্থে সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিত করা রাস্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতাকে উন্নত ও সভ্য দেশ বা জাতি হওয়ার অনেকটা ব্যারোমিটার হিসেবে দেখা হয় – যে দেশ যত উন্নত ও সভ্য সে দেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা তত বেশী অবাধ ও স্বাধীন। সাংবাদিকরা মানুষ, ফেরেশ্তা নিশ্চয়ই নন। তাই তারা তাদের রিপোর্টে, নিউজে, লেখাতে, উপস্থাপনায়, তথ্য আদান-প্রদানে ভুল করতেই পারেন এবং করাটাই স্বাভাবিক। এই ভুলগুলো শুধরানোর, ভুলের কারনে সংক্ষুব্ধ হওয়া ব্যক্তি প্রতিকার পাবার এবং সর্বোপরি সাংবাদিকদের জবাবদিহীতা নিশ্চিতের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি বিভিন্ন পন্থা ও উপায় আছে।
কিন্তু এজন্য সাংবাদিকদের জেলে যেতে হবে কেন? রাতের আঁধারে বাসায় গিয়ে গ্রেফতার করতে হবে কেন? ফৌজধারী মামলায় জড়াতে হবে কেন? সাংবাদিকদের লেখালেখি ও সাংবাদিকতার কারণে জেল হওয়া প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজে অকল্পনীয়। গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে সুনিশ্চিত।
সাংবাদিকদের আছে সুনির্দিষ্ট প্রফেশনাল প্রিভিলেজ। তারা তাদের তথ্যের সোর্স বা মাধ্যম প্রকাশে কোনভাবেই বাধ্য নন। এর মানে এই নয় যে সাংবাদিকরা ভুল করেন না বা তারা আইনের উর্ধে। সাংবাদিকরা বৃটেনে ভুল করলে বা মিথ্যা অথবা মিসলিডিং সংবাদ বা রিপোর্ট প্রকাশ করলে তা দেখা ও মনিটর করার জন্য Office of Communications (Ofcom) নামে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক শক্ত, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রেগুলেটরী অথরিটি আছে।
এই রেগুলেটরী অথরিটির কাজে সরকারের কোন হাত বা সংযোগ নেই, কোন প্রভাব থাকা তো দূরের কথা। অপরদিকে কোন রিপোর্ট বা সংবাদে কারো মানহানী হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কোর্টে মানহানীর (defamation or libel) মামলা করতে পারেন। তবে এই মানহানী মামলা দেওয়ানী (Civil) টাইপের। এ ধরণের মামলায় কখন কাউকে গ্রেফতার করা হয় না বা কোর্ট থেকে কোন সময়েই গ্রেফতারের জন্য অর্ডার দেয়া হয় না।
বৃটেনে লেখালেখির জন্য বা রিপোর্টের জন্য কখনও কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজধারী (Criminal) মামলা হয়েছে বা কোন সাংবাদিক জেলে গেছেন এমনটা কখনও শুনা যায়নি। উল্লেখ্য, বৃটেনে মানহানী মামলার ধরন ও প্রদ্ধতি দন্তহীন বাঘের মত নয় যা আমরা বাংলাদেশে দেখে থাকি।
বাংলাদেশে প্রায়ই শুনি ওমুক তমুক এত এত কোটি টাকার (ক্ষেত্র বিশেষ ১০ কোটি টাকা থেকে ১০০ কোটি টাকা!) মানহানীর মামলা করেছেন। মিডিয়ায় ফলাও করে আসে। এ পর্যন্তই! রায় হয়েছে বা সত্যিকার অর্থে ক্ষতি পূরন আদায় হয়েছে এমন সংবাদ কখনও শুনিনি। বৃটেনে মানহানী মামলা মানেই সাংঘাতিক কিছু। সঠিকভাবে শুনানী হবে, যথাসময়ে রায় হবে। মানহানী মামলা করা ও চালিয়ে যাওয়া এখানে খুবই ব্যয়বহুল। কোন ব্যক্তি মানহানী মামলা করে যদি সফল না হতে পারেন তাহলে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম বা সাংবাদিককে তার করা মামলা ডিফেন্ড করার আকাশচুম্বি খরচ উল্টো পরিশোধ করতে হবে।
ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানহানী মামলা করার আগে একাধিকবার চিন্তা করেন। বৃটেনে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা মূলত: ভয় করেন সাধারণ জনগণকে ও মানহানীর মামলাকে। সাধারণ জনগণকে ভয় করেন যদি তারা Ofcom -এ অভিযোগ করে বসেন।
Ofcom-এ অভিযোগ করলে Ofcom যথাযথ তদন্ত করে প্রমান সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের ব্যবস্থা নেয়। মানহানীর মামলাকে ভয় করেন কারণ যদি সংক্ষিব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্টান মানহানীর মামলা করে প্রমান করতে পারেন যে তার বা প্রতিষ্টানের মানহানী হয়েছে তখন তাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমান (Substantial) ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় যা অনেক সময় মিলিয়ন পাউন্ড ছাড়িয়ে যায়।
ইংল্যন্ডে কোন গণমাধ্যম বা সাংবাদিক সরকার বা তার কোন সংস্থা বা এজেন্সিকে মোটেই ভয় করেন না। সরকারের কোন এজেন্সি দ্বারা গণমাধ্যমে কোন সংবাদ বিশেষভাবে পরিবেশনে চাপ বা কোন সংবাদ নিয়ন্ত্রন বৃটেনের অবাধ তথ্য প্রবাহের সংস্কৃতিতে একেবারেই অপরিচিত। প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এমন কোন গণমাধ্যমের রিপোর্ট যদি সরকার আগাম জানতে পারে এবং তা বন্ধ করতে চায় তাহলে সরকারকে কোর্ট থেকে ইনজাংশন আনতে হবে।
কোর্ট সাধারনত অবাধ তথ্য প্রবাহের পক্ষে থাকেন এবং জরুরী কিছু বিষয় (যেমন রাস্ট্রীয় গোপনীয়তা, পাবলিক সেইফটি তথা জনগণের নিরাপত্তা ইত্যাদি) ছাড়া ইনজাংশন দিতে চান না।
বাংলাদেশের কোন গণমাধ্যম বা সাংবাদিক যদি সংবাদে বা রিপোর্টে মিথ্যা বা মিসলিডিং অথবা মানহানীকর তথ্য উপস্থাপন করেন তাহলে সেটি মোকাবেলা করা যেতে পারে তিনভাবে।
প্রথমত: সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমে অভিযোগ বা rejoinder পাঠিয়ে তা সংশোধন বা প্রতিকার পাবার আভ্যন্তরীন ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা।
দ্বিতীয়ত: বৃটেনের Ofcom এর মত সত্যিকার অর্থে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি কমিশন বা রেগুলেটরী বডি প্রতিষ্টা করা যাতে তারা যথাযথ প্রমান সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম বা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরনসহ বিভিন্ন ধরণের সেংশন আরোপ করতে পারেন। তবে রেগুলেটরী বডি হতে হবে সরকাবের সব ধরণের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
তৃতীয়ত: উপরের দুটি ব্যবস্থায় যথাযথ প্রতিকার না পাওয়া গেলে সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানহানীর মামলা করার অধিকার।
তবে বাংলাদেশের মানহানী মামলার ধরণ ও পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। ত্বড়িৎ গতিতে শুনানী করে প্রমানিত না হলে আবেদনকারীকে খরচ দেয়ার অর্ডার দিয়ে মামলা খারিজ করতে হবে। আর যদি প্রমানীত হয় তাহলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত পরিমান (Substantial) ক্ষতিপূরন দেয়ার ত্বড়িৎ ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের তাদের তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সম্ভাব্য প্রফেশনাল অবহেলার (Professional negligence) জন্য প্রফেশনাল ইনডেমনিটি ইনসুরেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে।
প্রমান সাপেক্ষে মানহানী মামলায় ক্ষতিপূরনের অর্ডার কোর্ট দিলে সেই ইনসুরেন্স কর্তৃপক্ষ তা পরিশোধ করবে। এতে করে প্রফেশনাল স্টেন্ডার্ডের গুনগত মান উন্নত হবে, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্টানিক ঝুঁকি কমবে এবং মানহানি মামলার পদ্ধতি যুগোপোযোগী হবে – এটাকে তখন আর দন্তহীন বাঘ বলা হবে না!
হাল আমলে বাংলাদেশে চালু হওয়া মানহানি মামলা রুজুর পদ্ধতি ও সংখ্যার ট্রেন্ড দেখে আৎকিয়ে উঠতে হয়। মানহানী মামলাসহ যেকোন মামলা তো করবেন শুধুমাত্র সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও তাও একটি – এটাইতো শাশ্বত নিয়ম। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি কোন পত্রিকায় নিউজ বা রিপোর্টের জন্য যার মানহানি হয়েছে বা যিনি সংক্ষুব্ধ হওয়ার কথা তিনি মামলা না করে যার সাথে ঐ সংবাদ বা রিপোর্টের কোন সম্পর্ক বা locus standi নেই সেই ব্যক্তি দস্তুরমত মামলা করে বসেন! শুধু তাই নয়, জেলায় জেলায় ডজন ডজন মামলা করা হয়, কোন সময় মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিক বা তার কাছাকাছি। এটা নি:সন্দেহে আইন, আদালত ও পদ্ধতির অপব্যবহার।
বৃটেনে কোন সংবাদ বা রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রী রিসি সোনাকের মানহানী হলে তার দল কনজারভেটিভ পার্টির কোন নেতা বা কর্মী প্রধানমন্ত্রীর জন্য বা পক্ষে মামলা করতে পারবে? একই বিষয়ে বৃটেনের সিটিতে সিটিতে কনজারভেটিভ পার্টির কোন নেতা বা কর্মী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মামলা করতে পারবে? এমন মামলা করলে কোর্ট আমলে (Entertain) নিবে? প্রশ্নই আসে না। এ ধরণের মামলা বারংবার (Repeated) করলে কোর্ট বরং তাকে Restraining Order এর আওতায় নিয়ে আসবে যাতে করে ভবিষ্যতে কোর্টের পারমিশন ছাড়া ঐ ব্যক্তি কোন মামলা করতে না পারে।
লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।