Saturday, November 23, 2024
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
Homeশিল্প-সাহিত্যসংবিধানের ভুল বা ইচ্ছাকৃত অনুবাদে “Local Government” হয়ে গেল “স্থানীয় শাসন”!

সংবিধানের ভুল বা ইচ্ছাকৃত অনুবাদে “Local Government” হয়ে গেল “স্থানীয় শাসন”!

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ: সংবিধান যে কোন দেশ বা জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন লিখিত দলিল। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশেরও বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ একটি সংবিধান নামক লিখিত দলিল আছে। এটির স্থান অন্য সব বিদ্যমান ও প্রচলিত আইনের উর্ধ্বে। খোদ সংবিধান [৭(২) অনুচ্ছেদ] স্পস্ট করে ঘোষনা দিয়েছে “…..এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷”

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতার পর আমাদের সংবিধান প্রণেতারা অনেক চিন্তাভাবনা ও গবেষনা করত: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধান যাচাই-বাচাই করে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেন যা ১৯৭২ সালে কন্সটিটুয়েন্ট এসেম্বলী (Constituent Assembly) দ্বারা গৃহীত হয়। তাই এত আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবিধান সম্পর্কে ব্যাখ্যা বা কথা বলতে হলে ঐতিহাসিক পেক্ষাপট, স্পিরিট, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ইত্যাদি বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। দু:খ লাগে যখন কেউ কেউ সংবিধানকে দেশ ও জাতির বৃহত্তর দৃষ্টিকোনের পরিবর্তে তাদের সংকীর্ণ ব্যক্তি ও দলীয় বা গোষ্টি স্বার্থে ব্যাখ্যা দেন বা দেয়ার চেষ্টা করেন।

সংবিধানকে সঠিকভাবে অনুসরণ, সংবিধানে উল্লেখিত সরকারের বিভিন্ন অঙ্গগুলোর দায়িত্ব অনুধাবন, সংবিধানে বর্ণিত অধিকারগুলো জনগণের জন্য নিশ্চিত করণ এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ ও জনসাধারণের মধ্যে টেকসই (sustainable) সম্পর্ক তৈরী করার জন্য সংবিধান ও তার অনুবাদ হওয়া উচিৎ সহজপাঠ্য, সঠিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ (consistent)। কিন্তু সংবিধানের ৩য় পরিচ্ছেদের (Third Chapter) অন্তর্গত ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ পড়ে তা হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং এখানে অর্থ ও অনুবাদকে বিকৃত করা হয়েছে।

তৃতীয় পরিচ্ছেদের ইংরেজি শিরোনাম (Title) এবং ৫৯ অনুচ্ছেদের উপ-শিরোনাম (Sub-title) হচ্ছে “Local Government” যার বাংলা অর্থ হবে “স্থানীয় সরকার”। কিন্তু সংবিধানে এটির বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে “স্থানীয় শাসন”। ঠিক অনুরূপভাবে ৬০ অনুচ্ছেদের ইংরেজি উপ-শিরোনাম হচ্ছে “Power of local government bodies” যার সহজ বাংলা অনুবাদ হওয়ার কথা “স্থানীয় সরকারের অঙ্গসমূহের ক্ষমতা”। কিন্তু সংবিধানে এটির বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে “স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা”। লক্ষ্য করার বিষয় যে ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ যেখানেই “Local Government” টার্মটি লেখা হয়েছে সেখানেই তার বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে “স্থানীয় শাসন” হিসেবে।

আবার মজার ব্যাপারে হচ্ছে, যে ৫৯ অনুচ্ছেদ ব্যবহৃত ইংরেজী “Administration” এবং “Administrative” শব্দদ্বয়ের সঠিকভাবে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে যথাক্রমে “প্রশাসন” ও “প্রশাসনিক”। যেমন অনুচ্ছেদ ৫৯(২)(ক)) বলেছে “administration and the work of public officers” যার বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে “প্রশাসন ও সরকারী কর্মচারীদের কার্য”। একইভাবে অনুচ্ছেদ ৫৯(১) ও ৫৯(২) – এ ব্যবহৃত “administrative unit” -এর ইংরেজী টার্মেরও সঠিকভাবে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে “প্রশাসনিক একাংশ”।

সত্যিকার অর্থে “local government” এর বাংলা অনুবাদ হবে “স্থানীয় সরকার” আর “local administration” এর বাংলা অনুবাদ হবে “স্থানীয় শাসন”। সংবিধানের ভুল অনুবাদে “Local Government” হয়ে গেল “স্থানীয় শাসন”! আর এর ফলে জনগণের সেবার ব্রত নিয়ে হওয়া সিভিল সার্ভেন্টরা নিজেদেরকে ভাবতে লাগলেন অনেকটা জনগণের প্রভু হিসেবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রচিন্তকরা ব্যাপারটি ভাল করে বুঝবেন এর সুদুর প্রসারী impact ও influence। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ আব্দুর রউফের সাথে এ নিয়ে বেশ লম্বা আলাপ হয়েছিল লন্ডনে বেশ কয়েক বছর আগে যখন তিনি লন্ডনে সফর করছিলেন। তিনিও একমত যে ভুল অনুবাদ করে “Local Government” তথা “স্থানীয় সরকার”কে ”স্থানীয় শাসন” হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাঁর ভাষায় “আমলা সাহেবরা সুকৌশলে মতলবী অনুবাদ করে জনগণকে সেবার পরিবর্তে তাদেরকে শাসন করছেন।”

অনেকে মনে করেন ভুল করে নয় বরং ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই এমন অনুবাদ করা হয়েছে। আর এ কাজটি করেছেন আমলারা তাদের নিজেদের কোটারী স্বার্থ বা কায়েমি স্বার্থ রক্ষা করেতে বা বজায় রাখতে। জনগণের নয় বরং সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার উর্ধ্বে উঠে জনগণকে শাসন করার নিমিত্তে সুচতুরতার সাথে জেনেশুনেই এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুবাদ করা হয়েছে। কথাগুলে একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়।

“স্থানীয় সরকার” ও “স্থানীয় শাসন” টার্ম দুটির ভাবার্থ ও চেতনা (spirit) মোটেই এক বা সমান নয়। “স্থানীয় সরকার” কনসেপ্টে আসে নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালনা করার নিয়ম ও বাধ্যবাধকতা। উন্নত গণতন্ত্রে স্থানীয় সরকারগুলো পরিচালিত হয় নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা সেখানে আমলাদের কোন দৌরাত্ম বা আধিপত্য থাকে না। যেমন বৃটেনে বিভিন্ন সিটি, মেট্রোপলিটন ডিস্ট্রিক্ট, ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল, পারিস কাউন্সিল, সিটি অব লন্ডন, কাউন্টি কাউন্সিল ও লন্ডন বারা কাউন্সিল নিয়ে স্থানীয় সরকার (local government) গঠিত। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি ইউনিট জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি তথা মেয়র, এসেমব্লী মেম্বার, লীডার ও কাউন্সিলর দ্বারা পরিচালিত হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রশাসন পরিচালনার জন্য একঝাঁক দক্ষ সিভিল সার্ভেন্ট থাকে যাদের নেতৃত্বে আছেন বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ডাইরেক্টবৃন্দ এবং তাদের সবার উপরে আছে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তথা Chief Executive Officer (CEO)। তবে বাংলাদেশের ইউএনও বা ডিসিদের মতো বৃটেনের local government -এর Director বা CEO -দের জনগণের উপর প্রাধান্য (prominency) নেই, আধিপত্যও (dominance) নেই।

অপরদিকে, “স্থানীয় শাসন” কনসেপ্ট আসে শাসন করার রেওয়াজ ও মানসিকতা থেকে। আমলা সাহেবরা কত সুক্ষ ও সুনিপূনভাবে টার্মগুলোকে আমাদের সমাজে তাদের মতো করে প্রচলন করেছেন যার সঠিক জিনিষগুলো শুনতে ও বলতে হয়তো নতুন নতুন লাগবে। যেমন ধরুন – ডিসি’র পূরো অর্থ বা মিনিং হচ্ছে “ডেপুটি কমিশনার” তথা “উপ কমিশনার”। এই ডিসি’র সংক্ষিপ্ত রূপকে কেন “জেলা প্রশাসক” বলে চালানো হচ্ছে তা বোধগম্য নয় যেমনটি ইংরেজীতে লেখা সংবিধানের ৩য় চ্যাপ্টারের অন্তর্গত ৫৯ অনুচ্ছেদে Local Government’কে বাংলায় “স্থানীয় সরকার” এর পরিবর্তে “স্থানীয় শাসন” হিসেবে চালানো হচ্ছে।

বাংলাদেশে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও ও জেলা পর্যায়ে ডিসিরা প্রচন্ড প্রভাবশালী, প্রতাপশালী ও ক্ষমতাশালী। অথচ এ দুটি পজিশন যথাক্রমে এডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাডারের ক্রমানুসারে একেবারে নীচু বা মাঠ পর্য়ায়ের ও মধ্যম সারীর। ইউএনও-এর পজিশন সহকারী সচিব থেকে বড়জোর সিনিয়র সহকারী সচিব পদ মর্যাদার। অপরদিকে ডিসি’র পজিশন হলে উপ-সচিব মর্যাদার। তার উপরে আরো চারটি ধাপ রয়ে গেছে: যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সিনিয়র সচিব। প্রশাসনের একেবারে নীচু ও মধ্যম সারীর ক্যাডার হওয়ার পরও ইউএনও ও ডিসিরা জনগণের উপর প্রচন্ড প্রভাব ও আধিপত্য খাটাতে পারেন। অথচ তাদেরকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সত্যিকার অর্থে স্থানীয় সরকারের ইউনিট দুটি তথা উপজেলা ও জেলাতে প্রশাসনগুলো পরিচালিত হওয়া উচিৎ ছিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা যারা থাকবে জনগণের কাছে দ্বায়বদ্ধ এবং জনগণ তাদের জবাবদিহীতা নিশ্চিত করবে। অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা হবে মূখ্য আর সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে ইউএনও ও ডিসিদের ভূমিকা হবে গৌন, পরোক্ষ ও সেবা দেয়ার মনোভাবসম্পন্ন (customer service mentality)।

জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে সংবিধানের ইচ্ছাকৃত অনুবাদের বদৌলতে ইউএনও ও ডিসিরা local government-এ শাসন করছেন। অথচ তারা হলেন সিভিল সার্ভেন্ট – মানে জনগণের সেবক। জনগণের সেবা করাই তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। বাস্তবতা হচ্ছে তারা করছেন শাসন, অনেকটা প্রভু হয়ে বা প্রভু মনে করে। তাইতো সেবক হিসেবে জনগণকে যেখানে তাদের “স্যার” সম্মোধন উচিৎ ছিল বরং সেখানে দেখি আমরা উল্টো। অনেক জায়গায় ইউএনও ও ডিসিদের “স্যার” সম্মোধন না করায় নাজেহাল হতে হয়েছে সাংবাদিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের। সাধারণ নাগরিকদের সাথে অহরহ কি আচরণ করা হয় তা বলাই বাহুল্য। অথচ গনতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে সাধারণ জনগণ যখন সেবা নেয়ার জন্য স্থানীয় সরকারে কর্মরত সিভিল সার্ভেন্টের কাউন্টার থেকে সর্বোচ্চ পদ চীফ এক্সিকিউটিভের অফিসে যান তখন তাদের উদ্দেশ্যে সিভিল সার্ভেন্টদের প্রথম বাক্যই থাকে “How can I help you Sir”? আর আমাদের সরকারী অফিসগুলোতে যেন সিভিল সার্ভেন্টরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন যে তাদেরকে সাধারণ জনগণ এসেই “স্যার” বলে ডাকবে! কদাচিত “স্যার” সম্মোধন না করলে বা করতে ভুলে গেলে কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়, ক্ষেত্র বিশেষ নাজেহাল বা লাঞ্ছিত করা হয়। এই হলো আমাদের সিভিল সার্ভেন্টদের মন-মানসিকতা।

সময় এসেছে সংবিধানের বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভুলটি সংশোধন করে “Local Government” এর অনুবাদ “স্থানীয় শাসন” এর স্থলে “স্থানীয় সরকার” প্রতিস্থাপন করা। এর সাথে সংবিধানের স্পিরিট অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের প্রতিটি ইউনিট জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালনা নিশ্চিত করা গেলে আমলাদের দৌরাত্ম বা অহেতুক আধিপত্য হ্রাস পাবে। ফলে তাদের মধ্যে জনগণের সেবা করার মনোভাব ও মাইন্ডসেট তৈরী হবে বা বৃদ্ধি পাবে।

লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।

Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments