নিজস্ব প্রতিবেদক: ছাত্র-জনতার মুখো ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে অবস্থান করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সরকার কবে পদত্যাগ করবে, এটা জানা ছিল না কারোই। কেউ কল্পনাও করেননি। সরকারের তরফে এখনো কিছু বলা হয়নি। শেখ হাসিনাও নিশ্চুপ। তবে নানা সূত্রে জানা যায়, ৪ঠা আগস্ট রাতেই শেখ হাসিনা জানতে পারেন- ছাত্র আন্দোলন এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যা নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। কিন্তু শেখ হাসিনা কোনো অবস্থাতেই পদত্যাগে রাজি হচ্ছিলেন না।
বরং তিনি আরও কড়া অ্যাকশনের পক্ষে অনড় ছিলেন। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছিল। কয়েক ঘণ্টা আগে ঢাকায় ফেরা ছোটবোন শেখ রেহানাও তাকে বোঝাতে ব্যর্থ তখন। একপর্যায়ে ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে। শুরুতে জয় ছিলেন ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত।
তার জবাব ছিল ‘আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন। আপনাদেরকে কীভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা ভুলে গেছেন।’ নিরাপত্তাবাহিনীর অনড় ভূমিকায় শেষ পর্যন্ত জয় তার মা শেখ হাসিনার পদত্যাগের পক্ষে সায় দেন। উপায়ান্তর না দেখে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় চিন্তা বাদ দিয়ে অবশেষে পদত্যাগে রাজি হন।
সূত্র বলছে, ৪ঠা আগস্ট রাতেই শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়।
কিন্তু তিনি তা মানতে রাজি ছিলেন না। দফায় দফায় বৈঠক, আলোচনা, পদত্যাগে সম্মতি আদায় এবং সর্বশেষ পদত্যাগপত্র প্রস্তুতিতে দ্রুত সময় ফুরিয়ে যায়। পরিস্থিতির বিষয়ে শেখ হাসিনাকে বাস্তব অবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল মর্মে অভিযোগ উঠেছে। এর জন্য বিভিন্ন মাধ্যম নানাজনের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের পেছনে ৪ জনের একটি চক্র বা ‘গ্যাং অব ফোর’- দায়ী বলে আওয়ামী লীগের এক নেতার বরাতে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম রিপোর্ট করেছে।
যা নিয়ে ঢাকায় রীতিমতো তোলপাড় চলছে। তাছাড়া বার্তা সংস্থা এএফপি’র বরাতে তাৎক্ষণিক দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে খবর রটে ৫ই আগস্ট আড়াইটায় বঙ্গভবন থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভারতের আগরতলা গেছেন, পরে দিল্লি। দেশ ছাড়ার আগে হাসিনা একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ পাননি।
ওইদিন সকালে ছোটবোনকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগ করেন বলেও খবর রটে। এসব খবরের সত্যতা নিশ্চিতে অবিরাম চেষ্টা চলছে। যদিও এখনো ধোঁয়াশা কাটছে না। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ৩ সপ্তাহ অতিবাহিত হতে চলেছে। মানবজমিনের অনুসন্ধান বলছে, শেখ হাসিনাকে ধারাবাহিকভাবে দেশের অবস্থা সম্পর্কে নানাভাবে জানানো হচ্ছিল। তিনি কারও কথাই কানে তুলছিলেন না।
একটি সূত্র বলছে, পদত্যাগ করতে শেখ হাসিনার সময়ক্ষেপণই জাতির জন্য কাল হয়। অন্যথায় গণভবনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে মানুষের ক্ষোভের থাবা কিছুটা কম হতো। ৫ই আগস্টের পরিস্থিতি শেখ হাসিনার বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য মোটেই অনুকূল ছিল না। সূত্র বলছে, জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিরাপত্তাবাহিনীর পরামর্শে সেদিন দুপুরে তিনি গণভবনে বসেই তার পদত্যাগপত্রে সই করেন।
যা দায়িত্বশীল ব্যক্তির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পৌঁছানো হয়। অন্য একটি সূূত্র বলছে, হেলিকপ্টারে চড়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়েননি। এমনকি আগরতলায়ও যাননি। সম্প্রতি বিমান বাহিনীর ফ্লিটে যুক্ত হওয়া সি-১৩০-জে সুপার হারকিউলেস এয়ারক্রাফ্ট-এ চড়ে শেখ হাসিনা সরাসরি দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তার আগে গণভবন থেকে কয়েক স্তরের নিরাপত্তায় তাকে তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে নেয়া হয়। সেখানে প্রস্তুত ছিল বৃটিশ এয়ারফোর্সে ব্যবহৃত হওয়া আমেরিকান কোম্পানি ম্যাকডোনাল্ড ডগলাসের তৈরি সি-১৩০ জে উড়োজাহাজ।
২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বৃটিশ কোম্পানি মার্শাল এয়ারস্পেসের মাধ্যমে ৫টি সি-১৩০ জে এয়ারক্রাফ্ট কিনেছে বাংলাদেশ এয়ারফোর্স। দায়িত্বশীলরা জানান, ঝুঁকিপূর্ণ যেকোনো অপারেশনে ওই এয়ারক্রাফটের উপর নির্ভর করা যায়। কারণ দীর্ঘপথে বিরতিহীন যাত্রায় সক্ষম বৃটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের অপারেশনে ব্যবহৃত ওই উড়োজাহাজ। সূত্র বলছে, আগে থেকে প্রস্তুত রাখা ওই উড়োজাহাজে ফ্লাই করেন শেখ হাসিনা। উড়োজাহাজ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বাইরে ফ্লাইটে শেখ হাসিনার একমাত্র সফরসঙ্গী ছিলেন তার ছোটবোন শেখ রেহানা।
হাসিনা ও রেহানাকে বহনকারী বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের উড়োজাহাজটি ঢাকা থেকে ননস্টপ ফ্লাই করে ৫ই আগস্ট সন্ধ্যায় দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে। সেখানে অপেক্ষমাণ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে রিসিভ করেন। দ্রুত ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স পাওয়াসহ শেখ হাসিনাকে গ্রহণের অন্যান্য প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রশাসন প্রধানতঃ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দপ্তরের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছিল।
বাংলাপেইজ/এএসএম