কুড়িগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন সরকার। দেশ-মাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে সক্রিয় অংশ নিতে গ্রামের যুবকদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। জীবনের পরোয়া না করে গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে অংশ নিলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মেলেনি তার।
মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি তার। অনলাইনে আবেদন না করায় আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি তার।
মোক্তার হোসেনের অভিযোগ, জেলা কমান্ডার, স্থানীয় প্রশাসন এমনকি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের দ্বারস্থ হয়েও কোনও প্রতিকার মেলেনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন অধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর স্বাক্ষরিত সনদ এখন তার কাছে তাই শুধুই একটি কাগজ।
মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন সরকার কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার উমর মজিদ ইউনিয়নের বালাকান্দি সবুজ পাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম রজব আলী সরকার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সব সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দলিল থাকলেও শুধুমাত্র অনলাইনে আবেদন করতে না পারায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হতে পারেননি তিনি।
স্বীকৃতি না পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, ১৯৭১ সালে তৎকালীন কুড়িগ্রাম মহকুমার উলিপুরের ব্রহ্মপুত্রের দইখাওয়ার চরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। মুক্তাঞ্চল খ্যাত রৌমারীতে গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন।
অস্ত্র হাতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের স্বাধীন মানচিত্র প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়ে নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। দেশের প্রয়োজনে সময়মতো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও জীবনযুদ্ধের কর্মব্যস্ততায় সরকারি তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়াতে অংশ নিতে পারেননি। ফলে তার অংশ নেওয়া যুদ্ধে দেশ স্বাধীনতা পেলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি এই গেরিলাযোদ্ধার।
মোক্তার হোসেন সরকার বলেন, ‘১৯৭১ আমি বয়সে তরুণ। রৌমারীতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিই। এরপর ১১ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান, কোম্পানি কমান্ডার আবুল কাশেম চাঁদ ও ৪ নম্বর প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন অধিনায়ক মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর স্বাক্ষরিত সনদ রয়েছে।’
যুদ্ধের পর জীবিকার প্রয়োজনে চট্টগ্রামে থাকায় এবং সনদটি খুঁজে না পাওয়ায় সময়মতো আবেদন করতে পারিনি জানিয়ে মোক্তার হোসেন সরকার বলেন, ‘পরে জমির দলিলের ফাঁকে সনদটি খুঁজে পাই। যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সব দলিল ও সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকলেও শুধু অনলাইনে আবেদন করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছি।’
স্বীকৃতি পেতে গত মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে একটি আবেদন জমা দেন মোক্তার হোসেন। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। ওই আবেদনপত্রের একটি কপি মোক্তার হোসেন যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। তাতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সিল-স্বাক্ষর সংবলিত মন্তব্যে লেখা রয়েছে, ‘অনলাইনে আবেদন না করে থাকলে এখন কিছুই করার নেই।’
মন্ত্রীর মন্তব্য লেখা আবেদনপত্রের কপিটি দেখিয়ে মোক্তার হোসেন বলেন, ‘সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সরাসরি তার হাতে আবেদন দিয়েছি। তিনি আবেদনপত্রের ওপর লিখে দিলেন ‘অনলাইনে আবেদন না করে থাকলে এখন কিছুই করার নেই।’ তাহলে আমি কার কাছে যাবো। দেশের জন্য যুদ্ধ করে এখন স্বীকৃতির জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কিন্তু এই যুদ্ধের শেষ কোথায়?।’
মোক্তার হোসেনের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার সহযোদ্ধা ও স্বীকৃতিপ্রাাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মকবুল হোসেন, আবদুস সালাম মিয়া ও মো. খবির উদ্দিন। তারা বলেন, ‘মোক্তার হোসেনসহ আমরা একই সেক্টরের অধীন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন এলাকায় না থাকার কারণে সময়মতো আবেদন করতে পারেননি। তার মতো বঞ্চিত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তির বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও কুড়িগ্রাম উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে থাকা উচিত। যারা প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিন্তু নানা সীমাদ্ধতার কারণে আবেদন করতে পারেননি; তাদের জন্য তালিকাভুক্তির সুযোগ থাকা উচিত।’
‘যারা যুদ্ধ করেননি কিন্তু সুযোগ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারেন, এমন আশঙ্কার কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার বাইরে রাখা উচিত নয়। আমার কথা হলো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তিনি যদি একজনও হন, তাহলে তাকে তালিকার বাইরে রাখা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধা নন এমন ব্যক্তিদের যেমন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে তেমনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরও তালিকাভুক্তি একটি চলমান প্রক্রিয়ায় থাকা উচিত।’ যোগ করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সমাজকর্মী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় মোক্তার হোসেনের আবেদন পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এখন কাগজপত্র নেই। আর ফোনেও এর সমাধান করা যাবে না। আমার মনে হয় উনি যদি আবারও আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তাহলে আমি সবগুলো কাগজপত্র দেখে সিদ্ধান্ত দিতে পারবো।’
বাংলাপেইজ/এএসএম