ব্যারিস্টার নাজির আহমদ:
বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার একই বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করেছে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনা হলেও বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে শত্রুমুক্ত হয় তথা বিজয় লাভ করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে আমাদের বিজয় দিবসের ঠিক দু’সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ২রা ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে।
অপরদিকে, কাতার স্বাধীনতা লাভ করে আমাদের বিজয়ের সাড়ে তিন মাস আগে। ১৯৭১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে ব্রিটিশ শাসন থেকে থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর।
কাতারের আয়তন সিলেট বিভাগের মত বা এরচেয়ে কিন্চিৎ ছোট। এত ছোট্র আয়তনের একটি দেশ কাতার সামগ্রিক উন্নয়নের দিক দিয়ে আজ কোথায় আর আমরা কোথায় পড়ে রইলাম? Per Capita Income – এ কাতার পৃথিবীর শীর্ষে। বর্তমানে মাথাপিছু আয়ের দেশ হিসেবে কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি। ২০১২ সালে কাতার বিশ্বের তৃতীয়বারের জন্য (মাথাপিছু আয় অনুসারে) শীর্ষে থাকা দেশটির খেতাব অর্জন করে। ২০১০ সালে প্রথম ইউরোপের ছোট্র ধনী রাষ্ট্র লুক্সেমবার্গকে পেছনে ফেলেছে।
কাতারের নাগরিক সুযোগ সুবিধার মান খুবই উন্নত। সেখানকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন নান্দনিক যা চোখে দেখার মতো। কাতারের রাজধানী দোহা এটি কাতারের বাণিজ্যিক অঞ্চল হওয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম উদীয়মান অর্থনৈতিক অঞ্চল, যার জন্য বিশ্বায়ন ও বিশ্বের শহর গবেষণা নেটওয়ার্ক এটিকে আন্তর্জাতিক শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৫ সালের মে মাসে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দোহাকে নতুন সপ্তাশ্চর্যের শহর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
গতবছর ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে দামী ও ব্যায়বহুল বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন করে বিশ্বকে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছে। ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে কাতার বিশ্বকাপের আয়োজন করেছে। অথচ আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমান ২০ বিলিয়ন ডলারেরও নীচে! কাতার রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় আন্তর্জাতিকমানের গণমাধ্যম আলজাজিরা প্রতিষ্টার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়াভাবে পরিচালিত হওয়া ও তথ্যপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রন করা অন্যান্য ট্রেডিশনাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে প্রতিযোগীতা ও চ্যালেঞ্জের মুখামুখি করেছে।
বাংলাদেশের মতো উর্বর ও নদীমাতৃক দেশ নয় কাতার। আরব উপদ্বীপের মত কাতার একটি উত্তপ্ত ও শুষ্ক মরু এলাকা। এখানে ভূ-পৃষ্ঠস্থ কোন জলাশয় নেই এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যাও যৎসামান্য। বেশির ভাগ লোক শহরে, বিশেষত রাজধানী দোহা শহর ও শহরতলীতে বাস করে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও এটি একটি তুলনামূলকভাবে দরিদ্র দেশ ছিল। কিন্তু দেশটি আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে!
অপরদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অর্ধেকের চেয়ে একটু বেশী। একই মাসে স্বাধীনতা লাভ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত আজ এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে যেখানে উন্নত বিশ্ব বিনিয়োগ করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা শুধু বিনিয়োগই করছেন না, তার সাথে সাথে তারা সেকেন্ড হোম হিসেবে দুবাইকে স্বাচ্ছন্দে বেঁছে নিচ্ছেন। দেশটি পূরো মরুভূমি (desert) এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী (natural scenery) না থাকার পরও দুবাই ও আবুধাবীকে কৃত্রিমভাবে পর্যটকদের জন্য খুবই চমকপদ ও আকর্ষণীয় করা হয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত আজ আরব বিশ্বের মধ্যে অন্যতম এক ধনী দেশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন ও গগণচুম্বী ভবন। স্বাধীনতার পর খুব কম সময়ে অনেকটা দরিদ্র ও অনুন্নত আরব আমিরাত বিশ্বের অন্যতম সুন্দর ও ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রথম শীর্ষ দেশ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তালিকায় সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩১তম দেশ।
দরিদ্র ও অনুন্নত অবস্থা থেকে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আজ উন্নতির শীর্ষ শিখড়ে। আর বাংলাদেশ? বাংলাদেশের কি নাই? চমৎকার ভৌগোলিক অবস্থানে অবস্থিত একাধিক সমুদ্রবন্দর সম্মলিত নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। পলিমাটিতে ভরা উর্বর ভূমি যেখানে যা-ই ফলানো হয় তা-ই ফলে। প্রায় একই ভাষায় কথা বলা ১৮ কোটি মানুষের চমৎকার Human Resources ও Human Capital – এর অপার সম্ভাবনাময় দেশ। তারপরও কাঙ্খিত উন্নতির শিখড়ে পৌছতে পারলো না কেন?
আমরা স্বাধীনতার পর অনেক কিছু পেয়েছি। নি:সন্দেহে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশার তুলনায় সেগুলো অনেক কম। বিভিন্ন কারণে দেশ আগাতে পারছে না। দেশ আগাবে কিভাবে? স্বাধীনতার পাঁচ দশকের উপর হয়ে গেল কিন্তু এখনও আমরা জাতীয় মৌলিক বিষয়গুলোতে একমত হতে পারিনি। এখনও আমরা তর্ক করি স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের মূলভিত্তি নিয়ে। বড়ই আপসুস্! আর এ সুযোগ নিয়ে মতলববাজরা ও স্বার্থবাদীরা যে যেভাবে পারে ঐ বিষয়গুলো সেভাবে মতলবি ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাচ্ছে। দলীয় দৃষ্টিকোন ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে তর্ক ও কুতর্ক করার প্রয়াস পাচ্ছে ঐ চিহ্নিত মহল। পাহাড়সম দূর্ণীতি আড়াল করতেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অনেকটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের আগে যেগুলোর কোন আলোচনাই হয় নাই, পূরো মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যে বিষয়গুলো কারও মানসপটে কখনও আসেনি সেসব বিষয়গুলোকে দেদারছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা স্বাধীনতার মূলভিত্তি হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে ঐ স্বার্থান্ধ ও মতলববাজ গোষ্ঠি। এর ফলে তরুন প্রজন্মরা হচ্ছে বিভ্রান্ত। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ বংশধররা হবে আরও বেশী বিভ্রান্ত। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন বা যারা মুক্তিযুদ্ধের সমসাময়িক তাদেরকে বিভ্রান্ত বা প্রতারিত করা কঠিন হলেও নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা খুবই সহজ। কেননা তারা স্বচক্ষে মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। শুনা কথার উপর ভিত্তি করে মরিচিকার পেছনে তারা দৌঁড়াবে। আর উড়োকথা বা শুনা কথার মধ্যে মনের মাধুরী মিশিয়ে মিথ্যা কিন্তু সহজে ঢুকিয়ে দেয়া যায়।
বাংলাদেশ আজ কোথায় যাবার কথা ছিল আর কোথায়ই বা পড়ে আছে? বায়ান্ন বছরের উপর বাংলাদেশের বয়স। এ বয়সটি মোটেই কম নয় একটি জাতির জন্য। জাতি হিসেবে আমাদের আজ আত্মসমালোচনা ও আত্মউপলব্ধি করার সময় এসেছে।
সময় এসেছে এগুলো নিয়ে সত্যিকার অর্থে ঠান্ডা মাথায় ভাববার, বিশ্লেষন করার, সোল- সার্চিং ও চিন্তা করার। আমাদের রাজনীতিবিদদের কি এ বোধশক্তি আছে? প্রতি বছর “স্বাধীনতা দিবস” ও “বিজয় দিবস” – এ দুটি দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে আসে এবং আমরা বেশ ধুমধামের সাথে তা পালন করে সেগুলোকে বিদায়ও দেই। কিন্তু এ দিবসগুলোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও তথ্যবহুল একাডেমিক আলোচনা হয় না বললেই চলে। এটা জাতির জন্য দূর্ভাগ্য।
অনেকে বলতে পারেন কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের কারণে এমন উন্নতির শীর্ষ শিখড়ে পৌঁছতে পেরেছে। কথাটা আংশিক সত্য। বাংলাদেশে হয়তো খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সেই দেশদুটির মতো নেই। তবে বাংলাদেশে স্রষ্টা প্রদত্ত (God gifted) অনেক কিছু আছে যা ঐ দেশ দুটিতে নেই। আর দেশের জণগনের উন্নত নৈতিক মান, দূর্নীতিমুক্ত সমাজ ও আইনের শাসনের পুরোপুরি বিদ্যমান না থাকলে শুধু প্রকৃতিক সম্পদ হলেই দেশ উন্নতির শীর্ষ শিখড়ে পৌঁছতে পারবে না। বরং তাতে দূর্নীতি আরও বাড়বে ও বিদেশে টাকা আরও বেশি বিদেশে পাচার হবে। চিন্তা করতে পারেন – বাংলাদেশের মতো একটি দেশ থেকে বছরে এক লক্ষ কোটি টাকার উপর পাচার হয়ে যায়! এমন দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ ও দেশ হলে তাতে দেশের ভূগর্ভে সোনার খনিও আবিস্কৃত হলে প্রত্যাশিত ও লাগসই উন্নয়ন হবে না। বরং দূর্নীতি ও টাকা পাচারের হার জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাবে।
চরমভাবে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত জাতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক হানাহানি ও পারস্পরিক অবিশ্বাস, দুর্নীতিকে স্বাভাবিক অবস্থা মনে করা, আইনের শাসনের অনুপস্থিত, স্বচ্চতা ও জবাবদিহিতার অভাব, আইনের শাসনের (Rule of Law) বদলে আইনের দ্বারা শাসনের (Rule by Law) চেষ্টা, সাধারণ জনগণের নৈতিকমান ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় – এগুলো যেন দেশটাকে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সব সময় পিছুটান করছে, সামনে এগুতে দিচ্ছে না। এগুলো বজায় থাকলে ভাসা-ভাসা (Superficial) বা প্রসাধনীমূলক (Cosmetic) উন্নয়ন হয়তো হবে তবে তা ঠেকসই বা লাগসই হবে না, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উন্নতির শীর্ষ শিখড়ে উঠাতো অনেক দূরের ব্যাপার।
আচ্ছা, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কথা বাদই দিলাম, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছর পূর্বে স্বাধীনতা লাভ করেছে এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো থাইল্যান্ড, মালেশিয়া ও সিংগাপুর। আজ তাদের অবস্থান কোথায় আর বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? তাদের তো খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ নাই। এগুলো ভাবলে খুবই দুঃখ লাগে। একই মহাদেশে এবং অনেকটা পাশাপাশি অবস্থান করে এবং সর্বোপরি সমসাময়িককালে স্বাধীনতা লাভের পরও থাইল্যান্ড, মালেশিয়া ও সিংগাপুর এতটুকু আগাতে পারলে আমরা পারি না কেন? আমাদের বাঁধাগুলো কোথায়? কি কি জিনিষ আমাদেরকে পিছু ঠানছে, আটকিয়ে রেখেছে? কেন আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি? কিসের অভাব আমাদের? এসব বিষয়গুলো প্রকৃতঅর্থে ভাবার সময় এসেছে। শুধু সময় এসেছে বললে ভুল হবে বরং ভাবার সময় আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে বললেও সম্ভবত: অত্যূক্তি হবে না।
পরিশেষে বলবো, বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। জাতি গঠন ও উন্নতির শীর্ষ শিখড়ে পৌঁছার সব উপাদানগুলো কাচাঁমালের মত বাংলাদেশে উপস্থিত। শুধু দরকার প্রকৃত দেশপ্রেমিক, ইস্পাত কঠিন সংকল্পবদ্ধ, দক্ষ ও আপাদমস্তক সৎ রাষ্ট্রনায়কের। বাংলাদেশ সঠিক নেতৃত্ব পেলে পত্পত্ করে উঠে যেতে পারে। ৫৩তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আমার ভাবনা – রাজনীতিবিদদের আত্মসমালোচনা ও আত্মউপলব্ধির সময় চলে যাচ্ছে। দেশ কোথায় আছে? কোথায় যেতে পারত? কি কি বাঁধা আছে কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌছার পথে? কিভাবে সে সব বাঁধাসমূহ দূর করা যায়? কিভাবে জাতিকে ঐকবদ্ধ করা যায়? দেরি না করে এগুলো নিয়ে এখনই ভাবুন। নতুবা ভবিষ্যত প্রজন্ম ও ইতিহাস আপনাদেরকে কখনই ক্ষমা করবে না।
লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk