ব্যারিস্টার নাজির আহমদ:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আপডেটেড সংবিধান বাংলা ও ইংরেজী মিলে মোট ২২৫ পৃষ্টা। এত বিস্তারিতভাবে বর্ণিত (Described in details) সংবিধান পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। আমি সংবিধানটি কয়েকবার ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড পড়েছি এবং এখনও সময় সময় প্রয়োজনে বিভিন্ন অনুচ্ছেদ চেক্ করি।
মাঝে মাঝে ভাবি – যতটুকু নীতিবাক্য ও বিধানসমুহ আমাদের সংবিধানের আছে সেগুলো যদি আমরা সবাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম তাহলে এ দিয়েই আমাদের দেশ সোনার দেশে পরিনত হতে পারতো। কিন্তু আফসুস্, অন্যান্য অনেক বিধানের মতো সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহ ও বাস্তবে সেগুলোকে ভোগ করতে দেয়া বা সুরক্ষার মধ্যে অনেক ফারাক।
চলুন এক নিমিষে দেখে নেয়া যাক নাগরিকের কোন কোন মৌলিক অধিকার তথা মানবাধিকারের দিয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের পুরো তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারের কথা চমৎকারভাবে বর্ননা করা হয়েছে। বিশেষ করে, উক্ত ভাগের ২৬ অনুচ্ছেদ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত নাগরিকদের বিভিন্ন মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ২৭ আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমতা নিশ্চিত করেছে, অপরিদিকে অনুচ্ছেদ ২৯ সরকারী নিয়োগ-লাভে সুযোগের প্রত্যেক নাগরিকের সমতা নিশ্চিত করেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪১ ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে, অপরদিকে অনুচ্ছেদ ২৮ ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করাকে নিষেধ করেছে। অনুচ্ছেদ ৩১ প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তি জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানিতে আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকার নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ৩২ নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণ করেছে।
প্রত্যেক নাগরিকের গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে বেশ কিছু রক্ষাকবচ নিশ্চিত করেছে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩। জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধকরণ করে এটাকে দন্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষনা দিয়েছে অনুচ্ছেদ ৩৪। অনুচ্ছেদ ৩৫ বিচার ও দন্ড সম্পর্কে ব্যক্তির শাশ্বত মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। অনুচ্ছেদ ৩৬ প্রত্যেক নাগরিকের বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করার অধিকার নিশ্চিত করেছে।
সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ যথাক্রমে সকল নাগরিকদের সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা দিয়েছে অনুচ্ছেদ ৩৯। অপরদিকে অনুচ্ছেদ ৪০ আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা দিয়েছে। অনুচ্ছেদ ৪২ ও ৪৩ যথাক্রমে সম্পত্তির অধিকার এবং গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণের অধিকার দিয়েছে।
Universal Declaration of Human Rights (UDHR) 1948 এবং International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) 1966 – এ দুটি আন্তর্জাতিক সনদের সদস্য ও স্বাক্ষরকারী (signatory) বাংলাদেশ। এই দুটি সনদ প্রতিষ্ঠিত তথা adopted হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবার অনেক আগে। তাই স্বাধীনতার পর যখন সংবিধান প্রনেতারা বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেন তখন তারা এই দুটি আন্তর্জাতিক সনদে বর্ণিত মানবাধিকারগুলো মাথায় রেখেছিলেন। তাইতো দেখা যায় UDHR এবং ICCPR-এ বর্ণিত বিভিন্ন মানবাধিকার প্রায় অভিন্ন ভাষায় বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
হাইকোর্ট হচ্ছে দেশের উচ্চ আদালত। সংবিধানের ১০১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের আদি, আপীল ও সহজাত এখতিয়ার ও ক্ষমতা আছে। হাইকোর্টকে বস্তুত: সংবিধানের গার্ডিয়ান বলা হয়। হাইকোর্টের বিচারপতিরা সাংবিধানিক পদধারী, শপথ নেন সংবিধান রক্ষার যে সংবিধানে সন্নিবেশিত আছে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকারের কথা।
সংবিধানের ৪৪ ও ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের যে কোন নাগরিক তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে হাইকোর্টে যথাযথ প্রতিকার চাইতে পারেন। বাংলাদেশের আর্ত-সামাজিক অবস্থার বাস্তবতায় হাইকোর্ট নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করণে কতটুকু সুবিচার করছেন বা করতে পারছেন সেটা অন্য বিতর্ক। তবে সংবিধান হাইকোর্টকে অসীম ক্ষমতা ও এখতিয়ার দিয়েছে।
মৌলিক অধিকারকে সংবিধান এতো গুরুত্ব দিয়েছে যে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে যে মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তার প্রারম্ভেই ২৬(১) অনুচ্ছেদে বলেছে “এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে”। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতেও রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারের সাথে অসমঞ্জস কোন আইন প্রনয়ন করতে পারবে না বলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে খোদ সংবিধান নিজে। সংবিধানের ২৬(২) অনুচ্ছেদ বলেছে “রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে”।
উপরে যা বর্ণিত হলো তা আমাদের মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে সংবিধানে লিখিত সব বিধিমালা। কিন্তু বাস্তবতা কি? সাধারণ নাগরিকরা কি সেই মৌলিক অধিকারগুলো পুরোপুরি ভোগ করতে পারছেন? বাস্তবে কি তাদের সেই সব মৌলিক অধিকার পুরোপুরিভাবে সুরক্ষিত? প্রধান বিরোধী দলসহ বিরোধি শিবিরের বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরাও বাংলাদেশের নাগরিক।
তাদের সবাইকে আইনের চোখে ক্ষমতাসীন দলের বা ক্ষমতাসীন শিবিরের নেতাকর্মীদের মতো সমান দেখা হয়? তারা সরকারী নিয়োগ-লাভে সমান সুযোগ পায় বা পাবে? তারা ক্ষমতাসীন দলের বা ক্ষমতাসীন শিবিরের নেতাকর্মীদের মতো সমাবেশ ও সংগঠন করতে পারে? তাদের গ্রেফতারে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ নিশ্চিত করা হয়? ক্ষমতাসীন দলের বা ক্ষমতাসীন শিবিরের নেতাকর্মীদের মতো তাদের বাক-স্বাধীনতা আছে বা তারা উনাদের মতো অবাধে চলাফেরা করতে পারেন? নাগরিকভেদে মৌলিক অধিকার ভোগ করাতে বা সুরক্ষাতে বৈষম্য স্পস্ট। তাদের জন্য এবং অনেক সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রেও মৌলিক অধিকারের অনেক বিষয় যেন “গোয়ালের গরু খাতায় আছে কিন্তু গোয়ালে নেই” এর মতে!
ইতিহাসের দিকে থাকালে স্পস্ট যে দিন দিন আমার খারাপ থেকে অধিকতর খারাপের দিকে যাচ্ছি। প্রায় গোটা আশির দশক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দূর্দান্ড প্রতাপে দেশ চালিয়েছেন। কত আন্দোলন, অবরোধ ও হরতাল হলো তার বিরুদ্ধে। পুলিশের ভুমিকা ও কর্মকান্ড তখন কেমন ছিল? পুলিশ মিটিং-মিছিলে ১৪৪ ধারা জারী করতো এবং তা ভাঙ্গলে বা না মানলে বড়জোর লাটিচার্জ করতো, নিক্ষেপ করতো টিয়ার গ্যাস।
২/১ টি মিছিলে ট্রাক তুলে দেয়ার ব্যতিক্রম ছাড়া এই-ই ছিল তখনকার সময়ে পুলিশের ভূমিকা ও একশ্যান। গুম ও ক্রস ফায়ারে/এনকাউন্টারে হত্যা তখন মোটেই শুনা যায় নি। আর পরবর্তী সরকারগুলোর সময়ে পুলিশের ভূমিকা? আর এখন পুলিশের ভূমিকা? আফসুস্, আস্তে আস্তে আমরা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?
ক্রস ফায়ারে/এনকাউন্টারে হত্যার মতো বেআইনী ও অসাংবিধানিক সংস্কৃতি চালু হয় দুই দশকের একটু আগে। প্রথম দিকে কিছু সত্যিকার অপরাধীকে হত্যা করা হলেও এটি পরবর্তিতে ব্যবহার হয় মূলত: বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। হাল আমলে এর মাত্রা ভয়াবহ ও বিপজ্জনক রূপ লাভ করে।
পৃথিবীতে কে জীবিত থাকবে বা কে জীবিত থাকবে না – এই সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব বা এখতিয়ার পুলিশের একজন সাধারণ এসআই’কে বা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সাধারণ সদস্যকে দিয়ে দেয়া কত যে ভয়াবহ ও জঘন্য তা কি রাষ্ট্র বুঝে? অথচ, এটা দেশের আইন, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ন বিরোধী।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তির জীবন নেয়ার আগে পাঁচটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।
প্রথমত: জেলার দায়রা জজ আদালতে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর আসামির ফাঁসির রায় হওয়া।
দ্বিতীয়ত: আপীল আকারে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কনফার্মের জন্য রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে যাওয়া সেই ফাঁসির রায় বহাল থাকা।
তৃতীয়ত: সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আপীল আকারে গেলে সেই ফাঁসির রায় বহাল থাকা।
চতুর্থত: সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে রিভিউতে গেলে সেই ফাঁসির রায় বহাল থাকা।
পঞ্চমত: রাষ্ট্রপতি ফাঁসির সাজা মওকুফ বা না কমানো। এই পাঁচটি ধাপের পরই কেবল কোন ব্যক্তির জীবন নেয়া যায়। তার বিপরীতে পুলিশের একজন সাধারণ এসআই’কে বা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সাধারণ সদস্যকে কোন ব্যক্তির জীবন নিয়ে নেয়ার এখতিয়ার দেয়া কত বড় জঘন্য অন্যায়, অবৈধ, বেআইনী ও অসাংবিধানিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
হাল আমলে চালু হওয়া আরেক জঘন্য সংস্কৃতি হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিককে গুম করা। গুম হত্যার চেয়েও জঘন্য ও মারাত্মক, কেননা হত্যা করে লাশ দেয়া হলে তার আত্বীয়-স্বজন কান্না কাটি করে অন্তত: এক সময় ছবর (ধৈর্য ধরবে) করবে এবং প্রতি বছর হত্যার দিনকে কেন্দ্র করে দোয়া-দুরুদ তথা ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করতে পারবে।
কিন্তু গুম হলে আত্বীয়-স্বজনরা মাসের পর মাস, এমন কি বছরের পর বছর পথ চেয়ে বসে থাকেন। আহা কি যন্ত্রণা! এ ছাড়া গুমের ক্ষেত্রে মারাত্মক আইনী জটিলতাও আছে। গুম হওয়া ব্যক্তির ব্যাংকের একাউন্ট পর্যন্ত বন্ধ করা যায় না এবং তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারের আইনগত কোন সুরাহা করা যায় না। এ কথাগুলো কি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে গুম করা অমানুষদের কানে পৌঁছবে?
বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো নাগরিকদের কতো না সুন্দর অধিকারের সনদ। বাস্তবে এগুলো সুরক্ষিত হলে, নাগরিকরা এগুলো দল মত নির্বিশেষে আক্ষরিক অর্থে সমানভাবে ভোগ করতে পারলে কত না সুন্দর দেশ হতো বাংলাদেশ। আর এতে হতে পারতো বাংলাদেশ বিশ্বের জন্য এক উজ্জ্বল নজীর। সাধারণ নাগরিকরা এমন এক বাংলাদেশ চান যেখানে সংবিধানে লেখা মৌলিক অধিকারগুলো আর বাস্তবে রক্ষিত বা ভোগ করা নাগরিকদের অধিকারের মধ্যে কোন ফারাক থাকবে না। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দি পরে বাংলাদেশের নাগরিকদের এই চাওয়া কি খুব একটা বেশী চাওয়া?
লেখক:বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk
বাংলাপেইজ/এএসএম