Saturday, November 23, 2024
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
Homeশিল্প-সাহিত্যসংবিধান একটি কার্যকর দলিল: এতে কোনো ইজম বা মতাদর্শ রাখলে কখনই অপ্রয়োজনীয়...

সংবিধান একটি কার্যকর দলিল: এতে কোনো ইজম বা মতাদর্শ রাখলে কখনই অপ্রয়োজনীয় সাংবিধানিক বিতর্কের অবসান হবে না

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে বহু মত, পথ, নীতি ও আদর্শের মানুষ বসবাস করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ ধরণের ভিন্নতা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সাধারণত: বামপন্থি রাজনীতি যারা করেন বা এই ধারা যারা বিশ্বাস করেন সমাজতন্ত্র তাদের নীতি ও মতাদর্শ। আবার ডানপন্থি রাজনীতি যারা করেন তারা অনেকটা রক্ষনশীলতায় বিশ্বাস করেন এবং আদর্শের ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের বিপরীতে তাদের অবস্থান। অপরদিকে ধর্মের ভিত্তিতে অনেক রাজনৈতিক দল আছে যারা সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ধর্ম থেকে অনুসৃত নীতি ও আদর্শে তারা বিশ্বাস করেন। এমতাবস্থায় কোনে বিশেষ ইজম তথা তন্ত্র বা মতাদর্শকে সংবিধানে স্থায়ীভাবে রেখে দিলে অন্য নীতি বা মতাদর্শ অনুসরণকারীদের উপর তা জোর করে চাপিয়ে দেয়া হবে বা তাদেরকে মানতে বাধ্য করা হবে। সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য যেখানে সবার সহাবস্থান দরকার সেখানে এভাবে চাপিয়ে দেয়া হলে বা মানতে বাধ্য করা হলে সাংবিধানিক উত্তেজনা সবসময় বিরাজ করবে। ফলে যে দলই যখন ক্ষমতায় যাবে এবং যখনই সুযোগ পাবে তখনই তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী মূলনীতিগুলো পরিবর্তন করতে থাকবে।বাংলাদেশের বিগত অর্ধ শতাব্দির ইতিহাসে এমন পরিবর্তন অনেকবার ঘটেছে।

সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ৮(১) অনুচ্ছেদে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। কিন্তু ৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এগুলোকে বলবৎ করতে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। Kudrat-E-Elahi v Bangladesh [44 DLR (AD) 319] মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে “These are principles as distinguished from laws and as such there is no question of application…” (অর্থাৎ “এই নীতিগুলো আইন থেকে আলাদা এবং তাই প্রয়োগের প্রশ্নই আসে না…”। এখন সঙ্গতভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে এই নীতিগুলো যদি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য না হয় তাহলে এগুলো সংবিধানে রাখার প্রয়োজনীয়তাই বা কি?

অনুচ্ছেদ ৮(২) স্পষ্ট করে বলেছে “এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে…..”। এখন প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রের ১৮ কোটি মানুষের কি একই নীতি ও আদর্শ হবে এবং তাদের কার্যের ভিত্তি হবে? ধরুন সমাজতন্ত্র একটি অন্যতম মূলনীতি। এই মূলনীতি সবাইকে মানতে হবে বা সবার জন্য মানা সম্ভব? আদালত কি রাষ্ট্রের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যা দিতে সমাজতন্ত্র দ্বারা নির্দেশিত (Guided) হতে পারবে? দেশের বড় দুটি দল যখন ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন বা করছেন তখন তাদের গৃহীত পুঁজিবাদি ব্যবস্থা ও মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতিও তো সমাজতন্ত্রের সাথে যায় না বা চলে না বা খাপ খায় না।

১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ঢুকানো হলো “সমাজতন্ত্র”। ১৯৭৯ সালে বিএনপি পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সমাজতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত (Defined) করে পরিবর্তন করলো এভাবে “অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার এই অর্থে সমাজতন্ত্র”। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটি পরিবর্তন করে আবার “সমাজতন্ত্র”কে মূলরুপে পুনঃস্থাপন করেন। ঠিক অনুরুপভাবে ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে সন্নিবেশিত ছিল “ধর্মনিরপেক্ষতা”। ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপি এটি পরিবর্তন করে প্রতিস্থাপন করলো “সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস”। ২০১১ সালে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করে আবার “ধর্মনিরপেক্ষতা”কে পুনঃস্থাপন করেন।

“জাতীয়তাবাদ”ও রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম প্রধান মূলনীতি, ক্রমানুসারে বরং প্রথম। কিন্তু জাতীয়তাবাদ নিয়ে জাতি দুভাগে বিভক্ত, বাংলাদেশের বড় দুটি দল ও তাদের বলয়ের অবস্থান দু’ধরণের। একটি বড় দল (ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ) ও তাদের রাজনৈতিক বলয় “বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ” নীতিতে বিশ্বাসী। অপরদিকে অন্য বড় দল ও বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল (বিএনপি) ও তাদের বলয় “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” নীতিতে বিশ্বাস করেন। তাদের এই দ্বিমত ও টেনশন সংবিধানে গিয়েও ঠেকেছে। ফলে এটি নিয়েও সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে একাধিকবার।

অরিজিনাল সংবিধানে জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে যা ছিল তা ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করে অনুচ্ছেদ ৬(২)’তে এ প্রতিস্থাপন করা হয় এভাবে “বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত হইবেন”। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৬(২) পরিবর্তন করে প্রতিস্থাপন করা হয় এভাবে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন”।

উপরের উদাহরণগুলো থেকে দেখা যায় যে বড় দল দুটির যে দলই যখন ক্ষমতায় যায় এবং যখনই সুযোগ পায় তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী মূলনীতিগুলো পরিবর্তন করতে থাকে বা থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো সংবিধান কি এভাবে স্ব স্ব দলের নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ঘনঘন পরিবর্তন করার জিনিষ? তাহলে লিখিত সংবিধানের প্রধান গুন বা বৈশিষ্ট (স্থায়ীত্ব, সহজে পরিবর্তনীয় নয়) থাকলো কোথায়? দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সংবিধান পরিবর্তন হতেই পারে। তবে স্থিতিশীল ও উন্নত গণতন্ত্রে দলীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে এত ঘন ঘন সংবিধান পরিবর্তন হয় না। মাত্র ৫২ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে ১৭ বার। অথচ ১৭৭৬ সালে Proclamation of Independence তথা স্বাধীনতা ঘোষনার পর ২৪৭ বছরের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যুক্তরাস্ট্র মাত্র ২৭ বার সংবিধান সংশোধন করেছে!

সংবিধান হচ্ছে কার্যকর (Operative) ডকুমেন্ট। এতে
নির্দিষ্ট (Particular) বা বিশেষ (Special) ইজম তথা মতবাদ বা মতাদর্শ (Ideology) রাখা ঠিক নয়। কেননা মতবাদ বা মতাদর্শ সংবিধানে থাকলে সংবিধান নিয়ে উত্তেজনা, অস্থিরতা, বাগাড়ম্বর, অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক ও ঘনঘন পরিবর্তনের প্রবনতা (Tendency) কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। গত ৫২ বছরের ইতিহাস তো তাই বলে।

“গণতন্ত্র”কে শক্ত, সুন্দর ও সঠিকভাবে সংবিধানে সন্নিবেশিত থাকবে এবং রাখা অত্যাবশ্যক। বাকী সব রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্ব স্ব মতবাদ বা মতাদর্শ অনুসারে ভোটারদের মন জয় করতে কাজ ও প্রচারণা নিরলসভাবে চালিয়ে যাবে। জনগণের সঠিক ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারলে তারা তাদের মতবাদ বা মতাদর্শ দিয়ে দেশ চালাবে পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পর জনগণের ভাল লাগলে সংবিধানে বর্ণিত গণতন্ত্র অনুয়াযী আবার সেই দল বা দলগুলোকে ক্ষমতায় পাঠাবে অথবা তাদের পরিবর্তন করে অন্য বিকল্প দল বা দলগুলোকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠাবে।

কোন ই্জম তথা মতবাদ বা মতাদর্শ সংবিধানে রাখা উচিৎ নয় বলে সেই ২০১১ সালে গঠিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সাব-কমিটিতে মত দিয়েছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ও মেধাবী জুরিস্ট ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল। লন্ডনে আমার সাথে আলাপে তাঁর কথা ছিল এমন “isms – such as socialism, capitalism, communism – should never be in the constitution. If these were in the constitution, political tension, deadlock and unnecessary debates would never end. [The] constitution is an operative document and democracy and democracy alone should be in it. Whichever party comes to office, with a mandate from the people, will run the country in accordance with its political ideology or ism” (অর্থাৎ “মতবাদ তথা সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদের মতবাদ – কখনোই সংবিধানে থাকা উচিত নয়। এগুলো সংবিধানে থাকলে রাজনৈতিক উত্তেজনা, অচলাবস্থা ও অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের অবসান হবে না। সংবিধান একটি কার্যকরী দলিল এবং গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্র একাই এতে থাকা উচিত। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বা মতবাদ অনুযায়ী দেশ চালাবে।”

ঠিক এই কথা বলে গেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইতে। তিনি বলেন: “ডিমক্রেসি, সোশিয়ালিযম, ন্যাশনালিজম ও সেকিউলারিজম: এই চারটিকে আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতি করা হইয়াছে। ……..কিন্তু আমার মত এই যে, এর কোনওটাই সংবিধানে মূলনীতিরূপে উল্লেখিত হইবার বিষয় নয়। গণতন্ত্র ছাড়া বাকী সবকটিই সরকারী নীতি – রাষ্ট্রীয় নীতি নয়।……..এই কারণে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা বিধান করিয়া আর- আর বিষয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গল।……সে জন্য দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে শুধু নিরংকুশ গণতন্ত্রের নিশ্ছিদ্র বিধান করিয়া বাকী সব ভাল কাজের ব্যবস্থা করা উচিৎ পার্লামেন্টের রচিত আইনের দ্বারা তা না করিয়া আইনের বিষয়বস্তুসমুহ সংবিধানে ঢুকাইলে সংবিধানের স্থায়িত্ব, পবিত্রতা ও অপরিবর্তনীয়তা আর থাকে না। নির্বাচনে যে দল বিজয়ী হইবেন, সেই দলই তাদের পছন্দমত সংবিধান সংশোধন করিয়া লইবেন, এমন হইলে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানের আর কোন দাম থাকে না” (পৃষ্টা ৬১৯)।

বিচারপতি মোস্তফা কামাল ও আবুল মনসুর আহমদের কত না ধীশক্তি ও সুদুরপ্রসারী চিন্তা ছিল সংবিধান নিয়ে! আমাদের দেশের সমসাময়িক রাজনীতিবিদরা কি তা হৃদয়াঙ্গম করতে পারেন? বাংলাদেশে ব্যক্তির জন্য একাধিকবার সংবিধান সংশোধনী করা যেমন একটি কালো দিক আবার সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে একাধিকবার সংবিধান সংশোধনী করা একটি পজিটিভ দিক। আমি নৈরাশ্যবাদী নই। রাজনীতিবিদদের উপর আস্থা রাখতে চাই। সংবিধান পরিবর্তন অবশ্যই হতে পারে। তবে তা হবে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে, কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শ বা মতবাদ প্রতিস্থাপন বা পুনঃস্থাপনের জন্য নয়। বিচারপতি মোস্তফা কামাল ও আবুল মনসুর আহমদের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই যে সংবিধান একটি কার্যকরী দলিল। এতে কোন ই্জম তথা মতবাদ বা মতাদর্শ রাখা উচিৎ নয়। কোনো নির্দিষ্ট ইজম বা মতাদর্শ সংবিধানে থাকলে কখনোই দেশে অপ্রয়োজনীয় সাংবিধানিক বিতর্কের অবসান হবে না।

লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।Email:ahmedlaw2002@yahoo.co.uk

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

Most Popular

Recent Comments